বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া চালুর দাবিতে গতকাল রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে কিছু ছাত্র লাঠিসোঁটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন। এরা ছাত্রলীগ কর্মী বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন।বাসে অর্ধেক ভাড়ায় (হাফ পাস) যাতায়াতের সুবিধা নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড় থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে নীলক্ষেত যাওয়ার সময় ঢাকা কলেজের উল্টো দিকের পেট্রল পাম্পের সামনে তাঁদের ওপর হামলা করা হয়। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগ এই হামলা করেছে। তবে এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ঢাকা কলেজে বর্তমানে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের ফোন করেও এ বিষয়ে কথা বলা যায়নি।
তবে নিউ মার্কেট থানার ওসি স ম কাইয়ুম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আইডিয়াল কলেজের ছাত্ররা ঢাকা কলেজের এক ছাত্রের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। এর পাল্টা ঘটনায় ঢাকা কলেজের ছাত্ররা আইডিয়াল কলেজের ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশ কোনো ছাত্রকে আটক করেনি। তবে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা আইডিয়াল কলেজের এক ছাত্রকে আটকে রেখেছিল। পরে দুই কলেজের শিক্ষকরা আলোচনা করে আইডিয়াল কলেজের ছাত্রকে নিয়ে যান।’
হামলার পর ছাত্ররা দাবি আদায়ে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন। হামলার প্রতিবাদে আজ বুধবার আবারও সড়ক অবরোধ করা হবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল আন্দোলনে নেমেছেন চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরাও। দাবি মানতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।
গত ৪ নভেম্বর ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়। এর পরও নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ ওঠে পরিবহন মালিকদের বিরুদ্ধে। এরপর শিক্ষার্থীরা গত ১৫ নভেম্বর থেকে হাফ পাসের আন্দোলন শুরু করেন। গত কয়েক দিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে এই আন্দোলন চলছিল। গতকালই শিক্ষার্থীদের ওপর প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে।
গতকাল রাজধানীর নীলক্ষেত ও সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ ও ধানমণ্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সায়েন্স ল্যাব মোড়ের অবস্থান শেষে ছাত্রদের একটি মিছিল নীলক্ষেত ঘুরে সায়েন্স ল্যাবে এসে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
মিছিল ঢাকা কলেজের উল্টো পাশে পৌঁছলে লাঠি, গাছের ঢাল নিয়ে একদল তরুণ তাঁদের ওপর হামলা চালায়। হামলাকারীদের কয়েকজন হেলমেট পরা ছিল। হামলায় শিক্ষার্থীদের মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এতে কয়েকজন আহত হন। হামলাকারীদের দুজন একজন ছাত্রকে ধরে নিয়ে মারধর করে। পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে করা সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনেও এই জায়গায় ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটে। তখনো হামলাকারী অনেককে হেলমেট পরে থাকতে দেখা যায়।
ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘আমরা সায়েন্স ল্যাব মোড়ে মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সামনে মোটরসাইকেলের সঙ্গে এক ব্যক্তিগত গাড়ির ধাক্কা লাগে। ওই গাড়ির যাত্রী এক নারীর সঙ্গে মোটরসাইকেলের যুবকটি তর্ক করছিল। আমাদের মিছিল যেহেতু এখান দিয়ে যাবে তাই আমরা কয়েকজন তাদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করি। এর এক পর্যায়ে ওই যুবকের সঙ্গে আইডিয়াল কলেজের কয়েকজন ছাত্রের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওই যুবক আরো কয়েক জনকে নিয়ে আসে। সেখান থেকে ঘটনা বড় হয়ে যায়।’ এই শিক্ষার্থীর দাবি, তাঁরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী না হলে এত দ্রুত লাঠিসোঁটা নিয়ে আসতে পারত না।
আন্দোলনকারী আরেক ছাত্র বলেছেন, আজকের (গতকাল) আন্দোলন তিন কলেজের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি হলেও এতে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের উপস্থিতি কম ছিল।
অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই ঘটনায় ছাত্রলীগের কেউ জড়িত নয়। বরং আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অতি উৎসাহী হয়ে ঢাকা কলেজের এক ছাত্রের ওপর হামলা চালিয়েছে। তার মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেছে।’
জাবি শিক্ষার্থীদের ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাফ পাসের দাবি মানতে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছেন। গণপরিবহনে হাফ ভাড়া নিশ্চিত করা ও শিক্ষার্থী-যাত্রী হয়রানি বন্ধসহ পাঁচ দফা দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো—সব রুটের বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া নিশ্চিত করা, সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ টাকা, গণপরিবহনের যাত্রাপথে চেক, ওয়ে বিল বাতিল ও বিআরটিএর আইন মেনে গেটলক-সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা এবং পরিবহনে যাত্রী হয়রানি বন্ধ করা।
চট্টগ্রামেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : হাফ ভাড়ার দাবিতে এবার আন্দোলনে নেমেছেন চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা। গতকাল নগরের ষোলশহর দুই নম্বর গেট মোড়ে ‘গণপরিবহনে হাফ ভাড়া চাই, চট্টগ্রাম’ ব্যানারে হাফ ভাড়াসহ পাঁচ দফা দাবিতে সমাবেশ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেখানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। সমাবেশ থেকে শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল জিইসি মোড়ে এসে শেষ হয়।
সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের’ ৯ দফায় ছিল। সে সময় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সেটি মেনে নিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন করেননি। উল্টো জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে শিক্ষার্থীদের ঘাড়েও বাড়তি ভাড়া চাপিয়ে দিয়েছেন। তাই গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিশ্চিত করতে সরকারকে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চট্টগ্রামের সংগঠক ও পটিয়া কলেজের শিক্ষার্থী জাহেদুল রাফি বলেন, ‘গাড়িভাড়া থেকে শুরু করে সব ধরনের খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু আমাদের বাবাদের বেতন তো বাড়েনি। করোনাসহ নানা সমস্যা মোকাবেলা করে পরিবারের খরচ বহনে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে এই ভাড়া বেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য অনেক বড় সমস্যা।’