জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট নিরসন কি কখনোই হবে না? | National University crisis will never be resolved?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়


বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষা বিতরণ করে না, শিক্ষার সৃষ্টি করে। আর উন্নত গবেষণার মাধ্যমেই সেটি সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নয়, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই গবেষণাই নেই। তাহলে শিক্ষার মান বাড়বে কীভাবে? তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আলাদা করে বলতে হয়। শিক্ষার সংকটের কারণে এখানকার প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন হতাশায় নিমজ্জিত। দেশের প্রতিটি স্তর সংকটে ভরপুর, এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট যেন তলানিতে পড়ে আছে, কিন্তু দেখার কেউ নেই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বছরে কয় দিন ক্লাস পান? তাঁদের শিক্ষার আয়োজন কতটুকু থাকে? 
নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে উচ্চশিক্ষায় আসা সর্বোচ্চসংখ্যক ছাত্রদের আশ্রয়স্থল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা টাকার অভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে নামতে পারেন না। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তো অনেক দূরের কথা। তাই বাধ্য হয়ে অবহেলা আর উদাসীনতার শিকার হয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।

উন্নয়ন পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। শিক্ষায়ও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বলে অনেকে দাবি করে থাকেন। তাঁরা হয়তো জানেন না দেশের শিক্ষার্থীরা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরেন, হতাশা হয়ে আত্মহননের পথও বেছে নেন কেউ কেউ। ১৯৯২ সালে উচ্চশিক্ষায় সেশনজট নিরসনের কথা বলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। দীর্ঘ ২৯ বছরে পা রেখেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়টির ব্যয় যত বেড়েছে, ভোগান্তিও বেড়েছে তত বেশি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সমস্যা কী? ২০১৪ সালের পরে সেশনজট নিরসন হয়েছে। কিন্তু পুরোনো সংকট নতুন রূপে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করেন না। কেন ক্লাসে আসেন না? এই প্রশ্ন নিয়ে ছাত্র–শিক্ষকের ভিন্নমতও আছে।
প্রশ্নটা হলো প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে পাস করা একজন শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কেন ক্লাস করতে চান না, তার কারণ কী? শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই, পরীক্ষার হলরুম নেই, অধিকাংশ কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, লাইব্রেরিতে বই নেই, অনেক কলেজে যাতায়াতের ব্যবস্থা নেই, বেশির ভাগ কলেজে আবাসনব্যবস্থা নেই। আর যে কটি ক্যাম্পাসে আবাসনসুবিধা আছে, সেগুলোয় আবার ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্তৃত্ব থাকে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়াতে কলেজগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা অবরুদ্ধ হয়ে আছে। এই সমস্যাগুলো চেপে ধরে বাস্তবে ক্লাস করা কতটুকু সম্ভব। বামপন্থীসহ অন্য কোনো ছাত্রসংগঠন শিক্ষার সংকট নিরসনের জন্য ক্যাম্পাসে আন্দোলন করলে সরকারি ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা হামলা-হুমকি-ভয়ভীতি প্রদর্শন করে থাকেন। সেই জায়গায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা কতটুকু নিরাপদ?
বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি কলেজ আছে ২ হাজার ২৭৪টি। এর মধ্যে ২৭৯টি সরকারি কলেজ। স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয় ১৮১টি সরকারি কলেজে। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রেডিং পদ্ধতির রুলস-রেগুলেশন অনুযায়ী বছরে ৩৬৫ দিনের ২১০ দিন ক্লাস হওয়ার কথা থাকলেও অনেক জায়গায় এর চার ভাগের এক ভাগও হয় না। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার কয়েক মাসে আগে গাইড বইয়ের সাজেশন ফলো করে মুখস্থ করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এভাবে চারটা বর্ষ শেষ করে মাস্টার্সে ওঠেন। মুখস্থবিদ্যায় গড়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাগার নেই কেন? করোনা মহামারির কারণে এখন পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাসের মুখ দেখেননি। ক্লাসের সিলেবাস শেষ না করেই গড়িমসি করে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, যা বাস্তবে অলিখিতভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে আদতে একটি ‘পরীক্ষাকেন্দ্র’ হিসেবে তৈরি করেছে।
নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, কেন তা ব্যর্থ হলো? বছরের পর বছর ধরে কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর অনাদরে সমস্যার স্তূপ জমতে জমতে পাহাড়সম আকার ধারণ করেছে। এর দায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এড়াতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক্রমে ইউজিসির ২০ বছর মেয়াদি কৌশলপত্রের চার পর্বে উচ্চশিক্ষার স্তর সাজানো হয়েছে, তা হলো প্রাথমিক–পরবর্তী ২০০৬-২০০৭, স্বল্পমেয়াদি ২০০৮-২০১৩, মধ্যমেয়াদি ২০১৪-২০১৯ ও দীর্ঘমেয়াদি ২০২০-২০২৬। দীর্ঘমেয়াদি কৌশলপত্রে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। কৌশলপত্রে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মান ও শিক্ষার সংকট দূর করতে হলে আগে কলেজগুলোর শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার অধিকার, সামাজিক অধিকার, সুস্থ রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বমানের পাঠদানের সঙ্গে চলতে হলে পাণ্ডিত্য ও গবেষণার মাধ্যমে নিত্যনতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করতে হবে, কার্যকর ও সময়োপযোগী শিক্ষণের মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞানের প্রয়োগ করতে হবে। চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়ে বৈষম্যহীন পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বাজেট দিতে হবে। সব শিক্ষার্থীর দ্রুত করোনার টিকাদান কর্মসূচি সম্পূর্ণ করতে হবে। পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে রুলস-রেগুলেশন অনুযায়ী ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র যদি ভান করে ঘুমিয়ে থাকে, তাহলে তাদের জাগানো কঠিন। রাষ্ট্রের ঘুম ভাঙানো ছাত্রসমাজের যেমন দায়িত্ব, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের দায়িত্ব শিক্ষার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।

ট্যাগ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget