লিভার সিরোসিস
প্রায়শই যেমনটি হয়, চেম্বারে ঢুকতে ঢুকতে সেদিনও কিছুটা দেরিই হলো এবং প্রতিদিনই যা হয়, চেম্বারে ঢোকার পরপরই আমার চেম্বার সহকারীরা এক গোছা স্লিপ নিয়ে হাজির। বিশিষ্ট যারা এবং সেই সাথে যারা বিভিন্ন রেফারেন্সে আমার কাছে আসেন তাদের প্রত্যাশা থাকে একটু আগে-ভাগে আমার সাথে চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শটুকু সারার। যে কারণে আমার চেম্বার সহকারীদের এই চিরকুটগুলো নিয়ে দৌড়ঝাঁপ। স্লিপগুলোয় চোখ বুলিয়ে দেখলাম একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির কজন আত্মীয় আর সাথে অনুসারী আমার সাক্ষাৎপ্রার্থী তার চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শের জন্য। তাড়াতাড়িই সুযোগ করে দিলাম তাদের।
তাদের প্রশ্ন অনেক, আছে কিছু ভ্রান্তি আর তথ্য বিভ্রাটও। পরিবারে বা নিকটজনদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকলে আমাদের রোগীরা প্রায়ই এমনি সমস্যায় পড়েন। দীর্ঘদিন ধরে রোগী দেখার অভিজ্ঞতায় এটি আমার কাছে নতুন কিছু নয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। তবে যা বাড়তি চ্যালেঞ্জ, তা হলো আমাদের অনেক সন্মানিত রোগীর পরিবারের সদস্যদের মতোই এক্ষেত্রেও আমাদের দেশের প্রাপ্ত আধুনিক চিকিৎসাগুলো সম্বন্ধে রোগীর লোকদের ধারণা খুবই কম। তার সাথে আবার যোগ হয়েছে নানা রকম অবিশ্বাস আর সন্দেহও। বুঝতে পারলাম এই রোগীর শুভাকাঙ্ক্ষীদের সন্তুষ্ট করাটা কঠিনই হবে।
রোগী সত্তরোর্ধ্ব, লিভারে সিরোসিস ছাড়াও নানা রকম সমস্যা আছে। আছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আর্থারাইটিস, হৃদরোগ আর ক্রনিক কিডনি ফেইলিওরও। লিভার সিরোসিসের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণও হয়েছে। রোগীর শুভানুধ্যায়ীদের নানা প্রশ্ন। তারা জানতে চান রোগী কোন রকম স্লো পয়জনিং বা বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছেন কি না। আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম বিষয়টি সেরকম নয়। কোন ওষুধ দিয়ে কিংবা স্লো পয়জনিংয়ের মাধ্যমে লিভারে আর যাই হোক সিরোসিস বাঁধানো যায় না।
বললাম বাংলাদেশে লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ তিনটি- হেপাটাইটিস বি ভাইরাস, ফ্যাটি লিভার আর হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। এর মধ্যে আবার অনেকগুলো রোগ আছে যে সবের কারণে লিভারে চর্বি জমে বা ফ্যাটি লিভার হয়। এসবের মধ্যে আছে মেদ-ভুড়ি, ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া বা রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপোথাইরয়েডিজম, পলিসিস্টিক ওভারি আর অ্যালকোহলিজম বা অতিরিক্ত মদ্যপান। তার মানে অবশ্য এই না যে কারও লিভারে হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাস ইনফেকশন কিংবা ফ্যাটি লিভার থাকলেই তার লিভারে সিরোসিস বা ক্যানসার হয়ে যাবে। যাদের লিভারে এই সমস্যাগুলো থাকে তাদের কারও কারও, বলা যায় ২০-৩০ শতাংশ মানুষের একটা সময় লিভারে সিরোসিস রোগটা দেখা দিতে পারে। আর এদের মধ্যে আরও প্রায় ২০ শতাংশ মানুষের একটা সময় লিভারে ক্যানসারও হতে পারে।
রোগীর শুভানুধ্যায়ীরা জানতে চাইলেন এ রোগীর জন্য স্টেম সেল থেরাপি করার কোনো সুযোগ আছে নাকি। তারা প্রয়োজনে রোগীকে বিদেশে নিয়ে স্টেম সেল চিকিৎসা করিয়ে আনতে চান। এবারো তাদের আমার হতাশ করতে হলো। বুঝিয়ে বললাম যে লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপি নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশে অনেক কাজ হচ্ছে। আমরাও ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসায় অটোলোগাস হেমোপয়েটিক স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন করে আসছি। আমরা এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত আমাদের অভিজ্ঞতার বিষয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নালে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশ করেছি। তাছাড়া বিভিন্ন সময় দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আর অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোয় প্রকাশিত রিপোর্টগুলোর সুবাদে দেশের লিভার রোগীরাও এ বিষয়ে এখন কম-বেশি জানেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিয়ে একটি ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যাতে দেশের মানুষ আরও সহজে এই চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে।
তাদের আরও বললাম যে আমরা যে শুধু লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় স্টেম সেলের ব্যবহার নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি তাই নয়, পাশাপাশি আমরা বাংলাদেশে অন্যান্য রোগের চিকিৎসায়ও স্টেম সেলের প্রচলন বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এদেশে সরকারি পর্যায়ে স্টেম সেল চিকিৎসার জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে, যেটি প্রণয়নে আমিসহ একাধিক লিভার বিশেষজ্ঞ জড়িত ছিলাম। পাশাপাশি বাংলাদেশ স্টেম সেল অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিন সোসাইটির উদ্যোগে চার বছর ধরে নিয়মিতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টেমকন নামে একটি স্টেম সেল কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যেখানে দেশ-বিদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও বেসিক সাইন্টিস্টরা যোগ দেন। বাংলাদেশ স্টেম সেল চিকিৎসায় এগিয়েছে অনেক দূরই। তবে সমস্যা হচ্ছে তাদের রোগীর রোগ এত বেশি বেড়ে গেছে যে এক্ষেত্রে স্টেম সেল প্রয়োগ করে আদৌ কোনো লাভ হবে বলে আমি মনে করি না।
রোগীর লোকজন বুঝলেন কি বুঝলেন না ঠিক বুঝলাম না, তবে তাদের পরের প্রশ্নটিতে আমি বেশ চমৎকৃত হলাম। তারা টিপস আর লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। অবশ্য তাদের জানায় কিছু ভুলও আছে। তাদের ধারণা আমেরিকা, ইউকে আর জার্মানির বাইরে পৃথিবীতে আর কোথাও টিপস কিংবা লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন হয় না। তারা জেনে কিছুটা অবাকই হলেন যে প্রতিবেশী ভারতেও নাকি টিপস হয় আর লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের জন্য ভারত পৃথিবীতে শীর্ষ পাঁচে আছে। সমস্যাটা সেখানে নয়। সমস্যা অন্য জায়গায় এবং সমস্যা বহুমাত্রিক। বুঝিয়ে বললাম তাদের সবই। লিভার সিরোসিসের সব রোগীর বেলায় টিপস প্রযোজ্য নয়। কারণ টিপস করার সময় হার্টের ভেতর দিয়ে লিভারকে একসেস করতে হয়। এতে কার্ডিয়াক এরিথনিয়া, পালমোনারি হাইপারটেনশন আর কার্ডিওপালমোনারি ফেইলিওর হতে পারে। পাশাপাশি ক্রনিক কিডনি ডিজিজের রোগীদেরও টিপস করা যায় না, কারণ টিপস করার সময় ডাই ব্যবহার করা হয়, যা এসব রোগীর কিডনি ফেইলিওরের কারণ হতে পারে। এতসব কিছু না থাকলেও লিভার সিরোসিসে টিপস ঝুকিপূর্ণ, কারণ টিপস করার পর রোগীদের হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি বা হেপাটিক কোমা হওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি।
অন্যদিকে যদি কারও লিভার আর কিডনি একসাথে খারাপ হয় তাহলে শুধু লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন করলেই চলবে না পাশাপাশি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে কিডনিও। এজন্য প্রয়োজন দুজন রিলেটেড অর্থাৎ আত্মীয় ডোনার, যাদের সাথে রোগীর শুধু ব্লাড গ্রুপই নয় পাশাপাশি এইচএলএ ম্যাচিংও লাগবে। আর অনাত্মীয় ডোনার দিয়ে, আমার জানা মতে, ইসরায়েলসহ পৃথিবীর হাতেগোনা দু-একটি দেশ ছাড়া অন্য কোথাও লিভার বা কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন করা হয় না এবং এই তালিকায় অবশ্যই ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানি নেই। তাছাড়া এই রোগীর এত বেশি কোমরবিডিটি অর্থাৎ আনুষঙ্গিক জটিল রোগ আছে যে এক্ষেত্রে লিভার বা কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের সুযোগও আছে বলে আমার মনে হয় না। তারা যদি আরও আগে যোগাযোগ করতেন ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন তো বটেই, এমনকি দেশেই স্টেম সেল থেরাপির মাধ্যমে হয়তো রোগীকে কিছুটা সাহায্য করা সম্ভব হতো।
লক্ষ্য করলাম, শুধু ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনই নয়, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সমন্ধে তাদের ধারণা খুবই ক্ষীণ। বলা চলে তারা এক্ষেত্রে কি ঘটছে, না ঘটছে এসবের কোনো খবরই রাখেন না। যেমন- তাদের ধারণা, লিভার সিরোসিসের কারণে পরিপাকতন্ত্রে যে রক্তক্ষরণ তার চিকিৎসা এদেশে নেই। অথচ লিভার সিরোসিস রোগীদের খাদ্যনালী আর পাকস্থলিতে ভ্যারিক্স বা রক্তনালী ছিঁড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণের চিকিৎসা আমার ছাত্ররাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগে নিয়মিত করছে।
একথা, সে কথায় আরও কিছু সময় পার হলো। তারা এক সময় বিদায় নিলেন। সাম্প্রতিক সময় লিভার সিরোসিস আর এর চিকিৎসা নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের পারদটা হঠাৎই ঊর্ধ্বমুখী। আমাদের শাস্ত্রে বৈজ্ঞানিক জার্নালে কেস রিপোর্টিংয়ের প্রচলন আছে, যাতে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা আমাদের কলিগদের সাথে শেয়ার করতে পারি। হঠাৎই মনে হলো এই কেসটা যদি বরং আর সবার সাথে শেয়ার করি তাহলে হয়তো অনেকেরই অনেক বিষয়ে ধারণাগুলো অনেকটাই স্বচ্ছ হয়ে যাবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন